বেকার ভাতা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মক্ষম হলেও তারা কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্বে ভুগছে। একজন শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ডিগ্রি অর্জনের পরও যদি চাকরি বা কাজ খুঁজে না পান, তখন তার জীবনে হতাশা নেমে আসে। সমাজ ও পরিবার উভয় দিক থেকে চাপ বেড়ে যায়। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় নাগরিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেই ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে বেকার ভাতা বা বেকারত্ব ভাতা।
বেকার ভাতা মূলত একটি আর্থিক সহায়তা, যা সরকার কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়া তরুণ বা নাগরিকদের সাময়িকভাবে জীবনযাপনের জন্য দিয়ে থাকে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ উন্নত বিশ্বে এটি দীর্ঘদিনের চর্চিত একটি ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে, তবে বাস্তবে খুব সীমিত পরিসরে কিছু পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ছাড়া পূর্ণাঙ্গভাবে বেকার ভাতা চালু হয়নি।
---
বেকার ভাতা: বিশ্ব প্রেক্ষাপট
জার্মানি: এখানে "Unemployment Benefit" বা "Arbeitslosengeld" নামে বেকার ভাতা চালু আছে। একজন বেকার নাগরিককে তার আগের বেতনের নির্দিষ্ট একটি অংশ সরকার প্রদান করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র: প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে unemployment insurance রয়েছে। চাকরি হারানো ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পান।
ভারত: কিছু রাজ্যে সীমিত পরিসরে বেকার ভাতা চালু রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও তামিলনাডু রাজ্যে শিক্ষিত বেকারদের মাসিক ১৫০০–২০০০ রুপি পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হয়।
---
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে এখনো জাতীয় পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ বেকার ভাতা কার্যক্রম চালু হয়নি। তবে কয়েকটি পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে:
1. কর্মসংস্থান ব্যাংক ও যুব উন্নয়ন প্রকল্প – এখানে প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে যুবকদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করা হয়।
2. ২০২০ সালের বাজেট প্রস্তাব – বেকার ভাতা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
3. কিছু স্থানীয় পর্যায়ে প্রোগ্রাম – উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে অল্প কিছু এলাকায় অস্থায়ীভাবে শিক্ষিত বেকারদের ভাতা দেওয়া হয়েছিল।
---
কেন বেকার ভাতা প্রয়োজন?
1. মানসিক চাপ কমানো: বেকারত্ব হতাশা, অবসাদ ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়। ভাতা থাকলে তা কিছুটা কমানো সম্ভব।
2. সামাজিক নিরাপত্তা: বেকার ভাতা সমাজের দুর্বল শ্রেণিকে টিকিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার।
3. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ভাতা পেয়ে বেকাররা অন্তত মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেন।
4. যুবসমাজকে স্বনির্ভর করা: যদি ভাতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ যুক্ত হয়, তাহলে বেকাররা দক্ষ হয়ে কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারেন।
---
বেকার ভাতা চালুর চ্যালেঞ্জ
বেকারের সংখ্যা বেশি: বাংলাদেশে প্রায় ২.৫–৩ কোটি মানুষ আংশিক বা পূর্ণ বেকার। সবার জন্য ভাতা দেওয়া কঠিন।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা: জাতীয় বাজেটের বড় অংশ উন্নয়ন প্রকল্পে যায়। বেকার ভাতা চালু হলে বছরে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে।
ডাটাবেইজ সমস্যা: কারা প্রকৃত বেকার আর কারা স্বেচ্ছায় কর্মহীন, সেটা নির্ধারণ করা কঠিন।
দুর্নীতি ও অনিয়ম: সঠিক তালিকা না থাকলে অযাচিত মানুষ ভাতা পাবে, অথচ প্রকৃত বেকার বঞ্চিত হবে।
---
কাদের জন্য বেকার ভাতা প্রয়োজন?
1. শিক্ষিত তরুণ-তরুণী – যারা ডিগ্রি অর্জন করেছেন কিন্তু চাকরি পাননি।
2. শারীরিক প্রতিবন্ধী বেকার – যারা কাজ করতে সক্ষম হলেও সুযোগ পাচ্ছেন না।
3. অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি – যেমন দরিদ্র পরিবার থেকে আসা বেকার যুবকরা।
4. গ্রামীণ বেকার – গ্রামে কৃষির বাইরে কাজ নেই, তারা ভাতার আওতায় আসতে পারে।
---
সম্ভাব্য কাঠামো
যদি বাংলাদেশ সরকার বেকার ভাতা চালু করে, তবে নিচের কাঠামো অনুসরণ করা যেতে পারে:
মাসিক ভাতা: ২০০০–৩০০০ টাকা
মেয়াদ: সর্বোচ্চ ২ বছর
শর্ত: প্রতি মাসে চাকরির জন্য আবেদন করার প্রমাণ, বা কোনো দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ
আবেদন প্রক্রিয়া: অনলাইন রেজিস্ট্রেশন + স্থানীয় ইউনিয়ন/পৌরসভা যাচাই
বিশেষ সুবিধা: প্রতিবন্ধী বা দরিদ্র পরিবারের বেকারদের জন্য অতিরিক্ত ভাতা
---
বাস্তব চিত্র
আজকের বাংলাদেশে অনেক তরুণ গ্রাজুয়েশন বা পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরও ৪–৫ বছর ধরে চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকেই হতাশ হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায় নামলেও মূলধন না থাকায় ব্যর্থ হচ্ছেন। এ বাস্তবতায় বেকার ভাতা চালু হলে অন্তত মৌলিক সহায়তা মিলবে।
---
প্রস্তাবনা
1. জাতীয় বেকার ডাটাবেইজ তৈরি করা
2. ভাতা ও প্রশিক্ষণ একসঙ্গে দেওয়া
3. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভাতা বিতরণ (যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট)
4. ভাতা গ্রহণকারীর চাকরির সুযোগ তৈরি হলে ভাতা বন্ধ করা
5. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া
---
উপসংহার
বেকার ভাতা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়, তবে এটি একটি সাময়িক সহায়তা যা হতাশাগ্রস্ত যুব সমাজকে টিকিয়ে রাখবে। সরকার যদি পরিকল্পিতভাবে এই ভাতা চালু করে, তাহলে তা শুধু সামাজিক সুরক্ষাই নয়, বরং অর্থনীতির গতি বাড়াতেও সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ হলো উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সাময়িক আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। তাই বেকার ভাতা চালু করা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জাতীয় প্রয়োজন