ভুমিকা
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এ দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের পথে এগোলেও গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। শিশুদের সঠিক পুষ্টি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা না গেলে একটি জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে।
এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার চালু করেছে শিশু ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচি। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করা।
শিশু ও মাতৃত্বকালীন ভাতার নীতিগত ভিত্তি
সরকারি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ভাতা চালু রয়েছে—বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি। তবে শিশু ও মাতৃত্বকালীন ভাতা তুলনামূলকভাবে নতুন উদ্যোগ, যা নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাসের কৌশল হিসেবে প্রবর্তিত হয়।
নীতিগতভাবে এই কর্মসূচি চালুর মূল কারণগুলো হলো:
- দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
- মায়েদের আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া।
- মাতৃত্বকালীন সময়ে নারীকে কর্মহীনতার কারণে অনাহারে না ফেলা।
- শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা ও টিকা কার্যক্রমে যুক্ত করতে উৎসাহিত করা।
কারা এ ভাতা পান?
শিশু ও মাতৃত্বকালীন ভাতার জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে:
- গ্রামীণ বা নগর দরিদ্র পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী মা।
- যাদের পারিবারিক মাসিক আয় সরকার নির্ধারিত সীমার নিচে।
- নবজাতক থেকে শুরু করে ৫ বছরের নিচের শিশুদের মা।
- অনগ্রসর ও দুর্গম এলাকার পরিবারকে অগ্রাধিকার।
ভাতার ধরন ও পরিমাণ
শিশু ও মাতৃত্বকালীন ভাতা সাধারণত নগদ অর্থ হিসেবে প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস (বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) এর মাধ্যমে সরাসরি মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী:
- মাতৃত্বকালীন ভাতা: সাধারণত মাসে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা।
- শিশু ভাতা: প্রতিটি শিশুর জন্য ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।
অঞ্চলভেদে এই পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।
আবেদন প্রক্রিয়া
ভাতা পাওয়ার জন্য মায়েদের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে। এতে দুর্নীতি কমেছে এবং সরাসরি উপকারভোগীর কাছে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে।
আবেদন করতে প্রয়োজন হয়:
- জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন
- সন্তানের জন্মসনদ
- পরিবারের আয়-সনদ
- ব্যাংক বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট
দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা
শিশু ও মাতৃত্বকালীন ভাতার প্রভাব বহুমাত্রিক:
-
পুষ্টি নিশ্চিতকরণ:
দরিদ্র মা ও শিশু অন্তত ন্যূনতম পুষ্টি পাচ্ছে, যা শিশু মৃত্যুহার কমাতে সহায়তা করছে। -
শিক্ষায় অংশগ্রহণ:
ভাতা প্রাপ্ত পরিবার শিশুদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছে। এতে ঝরে পড়া কমছে। -
নারীর ক্ষমতায়ন:
মায়ের হাতে সরাসরি টাকা যাওয়ায় পরিবারের আর্থিক সিদ্ধান্তে তাদের ভূমিকা বাড়ছে। -
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ:
মায়েরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকা ও চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছেন। -
দারিদ্র্য হ্রাস:
সামগ্রিকভাবে এটি দরিদ্র পরিবারের ব্যয়ভার কমাচ্ছে এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা
মমতা খাতুন (দিনাজপুর):
দুই সন্তানের মা মমতা খাতুন বলেন, আগে সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে পারতেন না। এখন ভাতা পাওয়ায় অন্তত চাল-ডাল কিনতে সমস্যা হয় না।
রুবিনা আক্তার (বরিশাল):
তিনি জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়ে তিনি সন্তান জন্মের সময় হাসপাতালের খরচ সামলাতে পেরেছেন। আগে এ ধরনের সহায়তা না থাকায় অনেক মায়ের জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকত।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
যদিও এ ভাতা দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করছে, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- তালিকা তৈরিতে অনিয়ম: প্রকৃত উপকারভোগী বাদ পড়ে যায়, আবার অযোগ্যরা তালিকায় ঢুকে যায়।
- ভাতার পরিমাণ কম: বর্তমান ভাতা দিয়ে পুরোপুরি পুষ্টি বা চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব হয় না।
- সব এলাকায় পৌঁছায় না: দুর্গম এলাকায় এখনো অনেক মা এই সুবিধা পাচ্ছেন না।
- সচেতনতার অভাব: অনেক মা জানেন না কোথায় বা কীভাবে আবেদন করতে হয়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
- ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি: বাস্তব খরচ অনুযায়ী ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন।
- ডিজিটাল ডাটাবেইজ: প্রতিটি শিশু ও মাকে নিবন্ধন করে স্বচ্ছ ডাটাবেইজ তৈরি করতে হবে।
- পুষ্টি ভাউচার ব্যবস্থা: শুধু নগদ নয়, খাবার ও ওষুধ কেনার জন্য ভাউচার দেওয়া যেতে পারে।
- সচেতনতা কর্মসূচি: মায়েদের মধ্যে সচেতনপতা বাড়াতে প্রচারণা বাড়াতে হবে।
- বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ: এনজিও ও দাতা সংস্থার সহযোগিতায় ভাতা কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা সম্ভব।
উপসংহার
শিশু ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ভাতা বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু দারিদ্র্য হ্রাসে নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ, শিক্ষিত ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।
যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ভাতা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। একটি শক্তিশালী ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে এ ধরনের কর্মসূচি অপরিহার্য।